বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে ঠেকবে দ্রব্যমূল্য?

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: কোণঠাসা হয়ে পড়েছে মানুষ। জীবন ধারণের খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষ। অনেকে খাবারসহ বিভিন্ন পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েও খরচের লাগাম টানতে পারছেন না। সংসারের আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানো হয়ে উঠেছে কঠিন। করোনা মহামারির শুরু থেকেই নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা থাকলেও মূল আঘাতটি আসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর। যার জের এখনো টানছে মানুষ।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে জড়ানোর পর থেকেই পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকে বিভিন্ন পণ্যের দাম। এরপর গত দেড় বছরে চাল, ডাল, কাপড় কাচার গুঁড়া পাউডার, সাবান, টুথপেস্ট, শ্যাম্পু, তেল, আটা, ময়দা থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। বেড়েছে সংসার খরচও।

তবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বেশির ভাগই দাবি করেছেন গত দেড় বছরে সংসারের খরচ ৫০ শতাংশের মতো বেড়েছে। কেউ কেউ বলেছেন- সংসার খরচ প্রায় ৮০ শতাংশ বেড়েছে। কেউ কেউ ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ হওয়ার কথাও বলেছেন। সেই তুলনায় বাড়েনি কারও আয়।

আমি সুযোগ পেলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলি। কোথায় সংকট তা জানতে চাই। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ১০০ শতাংশের ওপর দাম বেড়েছে বেশকিছু পণ্যের। এমনকি ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ার ঘটনাও ঘটেছে। তারা জানান, আগে যে চাল ৫৪-৫৬ টাকা কেজি বিক্রি হতো এখন সেই চাল ৭০-৭৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

খোলা আটা আগে ২৬-২৮ টাকা কেজি ছিল, এখন ৫০ টাকার ওপরে। যেসব প্যাকেট করা বেকারি পণ্য ৫০ টাকা বিক্রি হতো এখন তা ৬৫-৭০ টাকা। গায়ে মাখার যে সাবানের দাম ৪২ টাকা ছিল, তা এখন ৬২ টাকা। ৩৫০-৪০০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া জিরার দাম এখন ১২০০ টাকা। ৭৫-৮০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া চিনির দাম বেড়ে ১৩৫ টাকা হয়েছে। ৭০-৮০ টাকা বিক্রি হওয়া টুথপেস্টের দাম বেড়ে এখন ১৩০-১৩৫ টাকা। এভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বেড়েছে।

বেতন যা পাই, তার অর্ধেক যায় বাসা ভাড়ায়। বাকি অর্ধেক মাসের প্রথম সপ্তাহের বাজার খরচেই শেষ হয়ে যায়। ধারদেনা করে মাস কাভার করতে প্রতি মাসেই ঋণের বোঝা বাড়ছে। আগের তুলনায় এখন সংসারের খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এখন বাসার বাইরে কিছু খাওয়া মানেই যেন বিলাসিতা। জিনিসপত্রের যে দাম, অনেক হিসাব করে খরচ করি। এরপরও খরচের লাগাম টানতে পারছি না। এক হাজার টাকা নিয়ে বাজারে গেলে তেমন কিছুই কেনা যায় না।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিভিন্ন পণ্যের সর্বোচ্চ দাম। তাদের হিসাবে, ২২ সালের শুরুর তুলনায় বর্তমানে বিভিন্ন পণ্যের দাম ২ থেকে ২৭১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দেশি রসুনের দাম। ৭০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া দেশি রসুন এখন ২৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম বাড়ার হার ২৭১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২২১ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে দেশি আদার দাম। ১৪০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া দেশি আদা এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়।

১৯৫ শতাংশ দাম বেড়েছে জিরার। ৪০০ টাকার জিরা এখন ১ হাজার ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একশ শতাংশের ওপর দাম বাড়ার তালিকায় আরও রয়েছে দেশি শুকনা মরিচ। এ পণ্যটির দাম বেড়েছে ১৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এছাড়া আমদানি করা আদা ৯২ দশমিক ৩১ শতাংশ, আলু ৮০ শতাংশ, দেশি পেঁয়াজ ৮০ শতাংশ, চিনি ৬৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, রুই মাছ ৫৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, আমদানি করা রসুন ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ, আমদানি করা পেঁয়াজ ৫৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, দেশি হলুদ ৫৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও অ্যাংকর ডালের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবে দাম বেড়েছে অনেক বেশি।

মানুষ বেতনের টাকা দিয়ে সংসারের সব খরচ চালিয়ে আগে প্রতি মাসেই কিছু টাকা জমাতে পারতেন। কিন্তু এখন যে বেতন পান তার পুরোটাই খরচ হয়ে যায়। অথচ আগের তুলনায় কেনাকাটা ও খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই এখন জীবন বাঁচাতে যেটুকু কেনার দরকার, সেটুকুই কিনছে। বিক্রি কমে যাওয়ায় বিক্রেতাদের আয়ও কমেছে। কিন্তু বেড়েছে সংসারের খরচ। আগে মাসে যে টাকার বাজার-সদাই লাগতো, এখন তার দ্বিগুণের বেশি লাগছে।

নাগরিক মনে প্রশ্ন, নিত্যপণ্যের এই পাগলা ঘোড়া আর কতদূর যাবে? দ্রব্যমূল্যের দাম আর কতটা বাড়ার পরে থামবে? কতদূরেই বা যাবে? কবে গড়ে উঠবে নাগরিক সিন্ডিকেট? মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে অনেক আগেই।

বেতন যা পাই, তার অর্ধেক যায় বাসা ভাড়ায়। বাকি অর্ধেক মাসের প্রথম সপ্তাহের বাজার খরচেই শেষ হয়ে যায়। ধারদেনা করে মাস কাভার করতে প্রতি মাসেই ঋণের বোঝা বাড়ছে। আগের তুলনায় এখন সংসারের খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এখন বাসার বাইরে কিছু খাওয়া মানেই যেন বিলাসিতা। জিনিসপত্রের যে দাম, অনেক হিসাব করে খরচ করি। এরপরও খরচের লাগাম টানতে পারছি না। এক হাজার টাকা নিয়ে বাজারে গেলে তেমন কিছুই কেনা যায় না। মাছ কিনলে, দেখা যায় সবজি কেনার টাকা নেই। এগুলো কাউকে বলার কিছু নেই- আক্ষেপ করে কথাগুলো বলেছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা শাহ আলম। তিনি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা।

মতিঝিলের ফুটপাতে পুরুষের ব্যবহার্য পণ্য বিক্রি করেন জয়নাল। তিনি বলেন, বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি। এখন অনেক পণ্য আগের তুলনায় দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে। সবজি, মাছ, মাংস, ডিম সবকিছুর দাম বাড়তি। প্রতিনিয়ত খরচ বেড়েই চলেছে, কিন্তু আমাদের আয় তো বাড়ে না। দিনে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালানো বেশ কঠিন হচ্ছে। আমার হিসাবে আগের তুলনায় সংসারের ব্যয় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আগে বাজারে ৩০০ টাকা নিয়ে গেলে মোটামুটি ভালোই বাজার করা যেত, কিন্তু এখন ৫০০ টাকা নিয়ে গেলে তেমন কিছুই কেনা যায় না।

গত ৩০ অগাস্ট একটি অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এক প্রশ্নের জবাবে বললেন, আমাদের ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ পণ্য বাইরে থেকে আনতে হয়। সব জিনিস এক রকম হবে তা কিন্তু নয়। কখনো কখনো কোনো কোনো জিনিস একরকম হয়। পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেল, তখন ভারতে রেশনিং চালু করেছিল। যখন কাঁচা মরিচের দাম বাড়ল তখন ৩৫০ রুপিতে বিক্রি হয়েছে। এই মুহূর্তে দেখেন পেঁয়াজের ওপর ট্যাক্স বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা তাদের অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে কাজ করে। আমরা বিকল্প সোর্স থেকে আনার চেষ্টা করি।

সার্বিক মূল্যস্ফীতি নিয়ে তিনি বলেন, আপনারা যখন দেখেন ইংল্যান্ডের দোকানে তিনটার বেশি টমেটো কেনা যাবে না, সে বিষয়ে রেস্ট্রিকশন দিয়ে দেয়। জার্মানিও দোকানগুলোতে তেলের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়। আমাদের এখানেও নিশ্চয়ই প্রভাব পড়েছে। মুহূর্তের মধ্যে সমাধান হবে তেমন তো নয়, তবে আমাদের প্রতিনিয়ত চেষ্টা চলছে।

ইয়াহিয়া নয়ন, লেখক, সাংবাদিক।